C বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে?

বিজ্ঞান কী, কীভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে আমাদের সমাজের খুব কম মানুষেরই ধারণা আছে বলে মনে হয়। বিজ্ঞানের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কের কারণও সম্ভবত এটাই। বিজ্ঞান কী ও কীভাবে কাজ করে এ বিষয়ে অ্যা ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে স্টিফেন হকিং যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। এই বইয়ের অনুবাদক অনুবাদ করেছেন সে বইটিও। এখানে তার আলোকেই সংক্ষেপে বলছি।

বিজ্ঞান মূলত অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সমাবেশ। আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হলো একটি মডেল, যা পর্যবেক্ষণে পাওয়া ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সেটা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অনুমান বা পূর্বাভাস দিতে পারবে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে কখনোই সঠিক বলা যায় না। তত্ত্বের পূর্বাভাস পরিবর্তী পর্যবেক্ষণের সাথে হাজারবার মিলেও গেলেও আপনি বলতে পারবেন না তত্ত্বটা সঠিক বা নিঁখুত। হতে পারে, পরেরবারই পূর্বাভাস ভুল হয়ে যাবে।

পরিসংখ্যানবিদ জর্জ বক্সের কথাটি তাই যথার্থ।

সব মডেলই ভুল, তবে কিছু মডেল কার্যকর।

পরিসংখ্যানের ছাত্র ও শিক্ষক হওয়ার সুবাদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে সম্পর্কটা আরেকটু গভীর আমার। পরিসংখ্যানে আমরা ডেটা বা উপাত্ত নিয়ে কাজ করি। তারপর সেটা থেকে সবচেয়ে ভাল ভাল মডেল দিয়ে প্রেডিকশন বা পূর্বানুমান করি। যে মডেল সবচেয়ে ভালোভাবে পূর্বানুমান দিতে পার, সেটা নিয়ে আরও কাজ করি। জর্জ বক্সের কথা অনুসারেই, কোনো মডেলই বাস্তব জগতকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু যতটুকু পারে সেটা বাস্তব কাজকর্মের জন্যে যথেষ্ট। কার্যকর।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোও পর্যবেক্ষণে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এভাবেই কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের কথা। অনেক সুন্দর তত্ত্ব। কিন্তু আমরা জানি, এটা আসলে একটি ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্ব। বুধ গ্রহের কক্ষপথের সঠিক ব্যাখ্যা তত্ত্বটি দিতে পারেনি। যেটা পেরেছে আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব। কিন্তু আমরা আরও জানি, নিউটনের তত্ত্ব ভুল হলেও কার্যকর। এই তত্ত্ব দিয়েই মহাকাশে যান পাঠানো হয়। যদিও বড় ভরের বস্তুর ক্ষেত্রে তত্ত্বটি ভুল ফল দেয়। নিউটনের গতিবিদ্যাও সব রকম গতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। ব্যর্থ অতিপারমাণবিক জগতের কণার গতির ব্যখ্যা দিতে। বা আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলার বস্তুর গতির সঠিক বিবরণ দিতে। চিরায়ত গতিবিদ্যা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। পারে না আলোকতড়িৎ ক্রিয়া কিংবা হাইড্রোজেনের মতো সরল পরমাণুর ব্যাখ্যা দিতে।

নিউটনের তত্ত্বের বদলে আসা আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষ তত্ত্বও কি নিখুঁত? বিজ্ঞানীরা এখনই জানেন, তত্ত্বটায় ভুল আছে। যদিও ২০১৫ সালের মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারের মাধ্যমে তত্ত্বটি নিজের শক্তির জানান দিয়েছে। কিন্তু ঐ যে একই কথা। তত্ত্বটা কার্যকর। কিন্তু সঠিক দাবি করা যাবে না।

আকাশে গ্রহদের এলোমেলো চলাচল দেখে প্রাচীন গ্রিক জ্যোতির্বিদ টলেমি বলেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। সবাই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ঘুরছে গ্রহরাও পৃথিবীর চারদিকে নিজ নিজ কক্ষপথে। তবে গ্রহরা আবার নিজের কক্ষপথের মধ্যেই আরেকটি ছোট বৃত্তাকার কক্ষপথেও ঘুরছে। এর মাধ্যমে গ্রহদের এলোমেলো চলাচলের দারুণ ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। তত্ত্বটি দারুণ প্রশংসা কুড়াল। কিন্তু তত্ত্বটি অনুসারে চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব মাঝেমাঝে অর্ধেক সাধারণ দূরত্বের অর্ধেক হয়ে যাওয়ার কথা। যা ভুল। এভাবে ভাল এই তত্ত্বও ভুল প্রমাণিত হয়।

Ptolemy's model

Figure C.1: Ptolemy’s model

চিত্র: টলেমির মডেল। টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, এবং একে ঘিরে রাখা আটটি গোলক মহাকাশের সবগুলো বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিল।

এক কথায়, কোনো তত্ত্বই সঠিক নয়। নিছক কার্যকর। কাজে লাগিয়ে দারুণ কিছু কাজ করা যায় এই যা।

তাই বিজ্ঞান বা কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে বলা যায় না, আমি একে সত্য বলে মানছি। আবার এটাও বলা যায় না যে একে আমি পরিত্যাগ করব। বরং যতদিন কাজে লাগে ব্যবহার করব। তাই ধর্ম ও কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটাকে আরেকটার বিপক্ষে ব্যবহার করার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আরও দরকার সহনশীলতার চর্চা। জিনিসটার অনেক অভাব বর্তমান সময়ে।